পৌরাণিক দেবদেবী কেন্দ্রিক মোটিফ
বলা হয়ে থাকে ছত্রিশ কোটি দেব-দেবী আছে হিন্দু পুরাণে। তার মধ্যে কিছু
আছে অভিজাত- যাদের পুজা চলে সবসময়। এবং হিন্দু পৌরাণিক দেব-দেবীদের মধ্যে
এরাই প্রধান। যেমন- ব্রহ্মান, বিষ্ণু, মহেশ্বর, দূর্গা ও তার পরিবার, শিব,
কালী প্রভৃতি। পুঠিয়ার প্রতিটি মন্দিরেই এদের ইমেজ পাওয়া যায়। তবে একটি
মজার বিষয় হচ্ছে যে, টেরাকোটাগুলোয় শিব বা কালীর ইমেজ পাওয়া যায় না।
কালী ও শিবের ইমেজ ছাড়া মোটামুটি পরিচিত সব দেবতারই ইমেজ পাওয়া যায়। এই
দেবতাদের লৌকিক স্তরে নামিয়ে আনার কোন প্রবনতা নেই টেরাকোটাগুলোয়। এরা
স্বমুর্তিতে এবং স্বমহিমায় বিরাজমান।
সবচেয়ে বেশী ইমেজ পাওয়া যায় রাধা-কৃষ্ণের। অনেক স্টাইলের ইমেজ পাওয়া
যায়। রাধা-কৃষ্ণের শাশ্বত যুগল মূর্তি ছাড়াও পাওয়া যায় অনেক স্টাইলের
ইমেজ। যেমন- কোথাও কৃষ্ণ একাকী বাঁশী বাজাচ্ছে, কোথাও রাধা বংশী বাদক
কৃষ্ণের খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে, কোথাও কৃষ্ণ ব্রজ লীলায় মত্ত, কোথাও
বা কৃষ্ণ সখা-সখী পরিবেষ্ঠিত- রাস লীলায় মত্ত আবার কোথাও কৃষ্ণ গরু
চরাচ্ছে। কৃষ্ণের এমনি সব ইমেজ পাওয়া যায়। রাধা-কৃষ্ণ লীলার অনুষঙ্গ
হিসেবে এসেছে গাভী, বন, বাঁশি, নৌকা ইত্যাদি। পুঠিয়ার সব মন্দিরেই রয়েছে
কৃষ্ণ ও রাধার ইমেজ। উল্লেখ্য প্রতিটি মন্দিরেই রাধা-কৃষ্ণের ইমেজগুলো
প্রায় একই ধরনের।
অন্যান্য দেব-দেবীদের মধ্যে পাওয়া যায় ব্রহ্মা, দূর্গা, গনেশ, কার্তিক
ও স্বরস্বতী| ব্রহ্মার শাশ্বত মূর্তিই হচ্ছে ধ্যান মগ্ন। ধ্যানভঙ্গ
অবস্থায় ব্রহ্মার মূর্তি বিরল। টেরাকোটাগুলোতেও সেই ইমেজই বর্তমান। এখানেও
শশ্রুমণ্ডিত সৌম্যকান্তি ব্রহ্মা ধ্যানে মগ্ন। চার হাত চারদিকে। পদ্মাসনে
বসা।
হিন্দু পুরাণে বর্ণিত অবতারের ইমেজও রয়েছে টেরাকোটা গুলোয়। যেমন- নৃসিংহ
অবতার, মৎস অবতার। নৃসিংহ অর্ধেক মানুষ অর্ধেক সিংহের আকৃতি। ভীষণ দর্শন।
বরাহ অর্থ শুয়র। এর আকৃতি বিরাট। অর্থাৎ বিরাটাকায় শুয়র। মৎসের আকৃতিও
বিরাট। এই অবতারগুলোর শুধু ইমেজ আছে। ইমেজ এদের কোন ক্রিয়া নেই। অর্থাৎ,
এগুলো একদিকে তাকিয়ে থাকা ষ্টিল ফিল্মের মতই। দেব-দেবীদের মধ্যে আরও
পাওয়া যায় বিশ্বকর্মার ইমেজ। বিশ্বকর্মা স্বর্গের রাজমিস্ত্রী। এর বাহন
হাতি। এই সব দেব-দেবীর ইমেজ ছাড়াও পাওয়া যায় নৃত্যরত নারী-পুরুষের ইমেজ।
তবে এগুলো দেব-কি দেবী তা জানা যায় না। এদের বিশেষ ধরনের কোন পোশাক নেই।
নাচের মুদ্রা সবারই প্রায় একই ধরনের। এদের যে ধরনের পোশাক দেখা যায় তাতে
এদের দেব বা দেবী হিসেবে মনে হয় না। এগুলো হয়তো রাধা-কৃষ্ণের বিভিন্ন
লীলার সূত্র ধরে এসেছে।
টেরাকোটাগুলোতে বিভিন্ন ফুলের মোটিফ পাওয়া যায়। ফুল সবসময়ই পবিত্রতার
প্রতীক। মন্দির পবিত্র স্থান বলে ফুলের চিত্র বা ইমেজ এখানে থাকবে এটা
স্বাভাবিক| প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়- বাংলাদেশের যে কয়টি মন্দির বা মসজিদে
টেরাকোটা আছে যেখানে ফুলের মোটিফ রয়েছে। এই ফুলগুলো প্রায় অভিন্ন। যেমন-
দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, একই স্থানের নয়াবাদ মসজিদেও ফুলের মোটিফ
রয়েছে। এবং পুঠিয়ার মন্দিরের ফুলের মোটিফের সাথে এগুলোর সাদৃশ্য আছে। ফুল
ছাড়াও আলপনা পাওয়া যায় মন্দিরগুলোর টেরাকোটায়। আলপনা গুলি সরল। আশুতোষ
মিউজিয়ামে রক্ষিত হুগলি থেকে প্রাপ্ত সপ্তদশ শতকের টেরাকোটার আলপনার সাথে
পুঠিয়ার মন্দিরগাত্রের আলপনার মিল পাওয়া যায়। (দ্র. মহুয়া
মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘ধ্রুপদী নৃত্যের গৌড়ীয় জন্মসূত্র’- এ ব্যবহৃত
ছবি। দেশ-৬ মার্চ, ১৯৯৯)। মন্দিরের আলপনাগুলির প্রকৃতি সরল। বর্তমান কালে
যেমন বিভিন্ন মোটিফযুক্ত জটিল আলপনা (রাস্তায় তৈরী আলপনা-বিশেষ অনুষ্ঠানের
সময়ে তৈরী) দেখা যায় তেমন নয়। সম্ভবত সরল বলে সবাই একই রকমভাবে এগুলো
তৈরি করতো। যেহেতু এগুলো দেখে দেখে শিখতে হয় (আলপনা আঁকা বা তৈরি করার
নির্দিষ্ট কোন গ্রামার নেই। এটি অনেক বেশী অনুশীলন এবং সৃষ্টিশীলতার
বিষয়।) তাই মনে করা অসঙ্গত হবেনা যে এগুলো একটি নির্দিষ্ট ঘরাণার। ঘরাণার
কথা এই জন্য বলছি যে, পুঠিয়ার মন্দিরের বা আশুতোষ মিউজিয়ামের রক্ষিত বা
কান্তজীর মন্দিরের আলপনার টেরাকোটাগুলোর কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। হয়তো কোন
উৎস থেকে এগুলো সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘকাল চলতে থাকে। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে
একই রকম ধারায় চলতে থাকে। বর্তমানে যেমন পাকা ঘরের ঘুলঘুলি বা
ভেন্টিলেটরের কাজ। এগুলোরও কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। (এগুলো টেরাকোটা নয়।
সিমেন্ট দিয়ে তৈরী বিশেষ ধরনের নকশা কাটা ঢাকনি)। আলপনার টেরাকোটাগুলো একই
রকম হবার আরও একটি কারণ আছে তা হলো- পুঠিয়ার টেরাকোটা তৈরির জন্য বেনারস
থেকে শিল্পী আনা হয়েছিলো। কান্তর্জী মন্দিরের টেরাকোটা তৈরির জন্যও ভারত
থেকে শিল্পী আনা হয়েছিল। তারা মোটামুটি একই সংস্কৃতি-বলয়ের মানুষ। একই
সূত্র থেকে আলপনার ছাঁচ পাওয়া তাদের জন্য বিচিত্র কিছু নয়।
আলপনা ছাড়াও এখানে বিভিন্ন লতানো উদ্ভিদের মোটিফযুক্ত টেরাকোটা পাওয়া
যায়। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এগুলোর উপর থেকে নিচে বা ভূমি সমান্তরালে
ডান থেকে বাঁয়ে প্রাচীরের এক প্রান্ত অন্য প্রান্তে শেষ এবং এগুলো একদিক
থেকে শুরু হয়। (মন্দির প্রাচীরের থামের কাছ থেকে নতুন ভূমি সমান্তরালে নিচ
থেকে)। টেরাকোটাগুলির একটি জায়গা খুব নজর কাড়ে তাহলো অভিব্যক্তি। কি
রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়, কি রামায়ন- মহাভারতের যুদ্ধ প্রত্যেকটি জায়াগায়
ইমেজগুলোর অভিব্যক্তি অসাধারণ। রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীর যে জায়গাাগুলোয়
রোমান্টিকতা বেশী সেখানকার অভিব্যক্তি স্পষ্ট। রাধা লজ্জায় আরক্ত, কৃষ্ণ
উৎফুল্ল কিংবা নৌকা ডুবে যাওয়ায় সখীদের ভয়ার্ত মুখাবয়ব, কৃষ্ণের
উল্লাসের অভিব্যক্তিগুলো একেবারে টানা। অপরদিকে যুদ্ধের ইমেজগুলোয়
যোদ্ধাদের পৌশাচিকতা, ছুটন্ত ঘোড়ার ক্লান্তি, ক্রুদ্ধ হাতি, ভয়ার্ত
মানুষ, মৃত-আহত মানুষের অভিব্যক্তি স্পষ্ট।
যুদ্ধের ভয়াবহতার দিকটি খুব ঋজুভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে
টেরাকোটাগুলোয়। হস্তি বাহিনীর পায়ের তলায় পিষ্ট মানুষ, ঘোড়ার পায়ের
তলায় পিষ্ঠ মানুষ, অস্ত্রের আঘাতে মুমূর্ষু মানুষের ইমেজগুলো স্পষ্ট।
উন্মত্ত হাতি মানুষকে তাড়া করছে এবং এক সময় শূঁড়ে পেঁচিয়ে বা পায়ের
তলায় পিষ্ঠ করে মেরে ফেলছে। কিংবা ছুটন্ত ঘোড়ার পায়ের তলায় মানুষ পিষ্ঠ
হয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যগুলো কল্পনা করলে যতটা বিভৎসতা চোখে ভাসে ঠিক ততটাই
বিভৎস করা হয়েছে টেরাকোটার ইমেজগুলো। এমনকি হাতির পায়ের তলায় পিষ্ঠ হয়ে
মানুষ যে চিৎকার করছে, চোখ বিষ্ফোরিত এই অভিব্যক্তিগুলি স্পষ্ট বলেই
যুদ্ধের বিভৎসতার বিষয়টি চোখে পড়ে।
সিংহের পিঠে দশহাত নিয়ে দূর্গর ইমেজ রয়েছে টেরাকোটাগুলোয়। দশ হাতে
ধারণ করা দশটি বস্তু (শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মা, ইত্যাদি)। গনেশ, কার্তিক
তাদের কল্পিত ভঙ্গিতে ও বাহনেই বর্তমান। কোন ব্যাতিক্রম নেই।