20 September 2020

পঞ্চরত্ন বড় গোবিন্দ মন্দির




পাঁচ আনি রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে পূর্ব অংগনের (মন্দিরাঙ্গন) মধ্যস্থলে এই মন্দিরটি অবস্থিত। একটি সুউচ্চ বর্গাকার মঞ্চের উপর স্থাপিত মন্দিরটির ভূমি নকশা পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের মতই। তবে মন্দিরটির বহির্দেয়ালগাত্রের সম্পূর্ণ অংশ দিনাজপুরের কান্তনগরের নবরত্ন মন্দিরের ন্যায় পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অপূর্ব অলঙ্করণে সজ্জিত।
অলঙ্করণ বিষয়বস্তু হিসেবে রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলী উপস্থাপনের পাশাপাশি মুসলিম স্থাপত্য অলঙ্করণের বীমূর্ত বিষয়বস্তুসহ তদানীন্তন সমাজ ব্যবস্থারও একটা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। ভূমি নকশা অনুযায়ী মন্দিরটি মূল গর্ভগৃহকে কেন্দ্র করে মূলত পাঁচটি বর্গাকার ও চারটি স্বল্প আয়তনের আয়তাকার কক্ষে বিভক্ত। চারদিকের আয়তাকার কক্ষ চারটি প্রকৃতপক্ষে বারান্দা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বর্গাকার কক্ষ সমূহের অন্তরস্থ উপরিভাগ অর্ধবৃত্তাকৃতির গম্বুজ ও আয়তাকার কক্ষ বা বারান্দা সমূহের উপরিভাগ খিলানছাদে (ছই আকৃতির) আচ্ছাদিত হলেও বহির্ভাগ সমতল করে কেন্দ্রীয় কক্ষ এবং চার কোণার ক্ষুদ্র কক্ষ চারটির উপরে পাঁচটি রতন্ স্থাপিত হয়েছে। রত্ন সমূহের উপরিভাগ পিরামিড আদলের চৌচালা ছাদে আচ্ছাদিত। মন্দিরের চারদিকের বারান্দাসমূহ তিনটি করে অর্ধবৃত্তাকার খাঁজখিলান পথে উন্মুক্ত।
মন্দিরটি কে, কখন নির্মাণ করেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে মন্দিরটির পশ্চিম বহির্দেয়ালগাত্রের শীর্ষভাগে স্থাপিত একটি ভগ্ন শিলালিপিতে প্রেমনারায়ণস্য দৃষ্টে পুঠিয়া রাজবংশ গ্রন্থের লেখক বিমলাচরণ মৈত্রেয় অনুমান করেছেন যে, হয়তোবা মন্দিরটি রাজা প্রেমনারায়ণ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। তাঁর এই অনুমান যথার্থ হলে মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে নির্মিত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
বর্গাকার কক্ষ সমূহের অন্তরস্থ উপরিভাগ অর্ধবৃত্তাকৃতির গম্বুজ ও আয়তাকার কক্ষ বা বারান্দা সমূহের উপরিভাগ খিলানছাদে (ছই আকৃতির) আচ্ছাদিত হলেও বহির্ভাগ সমতল করে কেন্দ্রীয় কক্ষ এবং চার কোণার ক্ষুদ্র কক্ষ চারটির উপরে পাঁচটি রতন্ স্থাপিত হয়েছে। রত্ন সমূহের উপরিভাগ পিরামিড আদলের চৌচালা ছাদে আচ্ছাদিত। মন্দিরের চারদিকের বারান্দাসমূহ তিনটি করে অর্ধবৃত্তাকার খাঁজখিলান পথে উন্মুক্ত।
মন্দিরটি কে, কখন নির্মাণ করেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে মন্দিরটির পশ্চিম বহির্দেয়ালগাত্রের শীর্ষভাগে স্থাপিত একটি ভগ্ন শিলালিপিতে প্রেমনারায়ণস্য দৃষ্টে পুঠিয়া রাজবংশ গ্রন্থের লেখক বিমলাচরণ মৈত্রেয় অনুমান করেছেন যে, হয়তোবা মন্দিরটি রাজা প্রেমনারায়ণ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। তাঁর এই অনুমান যথার্থ হলে মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে নির্মিত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
বর্গাকার কক্ষ সমূহের অন্তরস্থ উপরিভাগ অর্ধবৃত্তাকৃতির গম্বুজ ও আয়তাকার কক্ষ বা বারান্দা সমূহের উপরিভাগ খিলানছাদে (ছই আকৃতির) আচ্ছাদিত হলেও বহির্ভাগ সমতল করে কেন্দ্রীয় কক্ষ এবং চার কোণার ক্ষুদ্র কক্ষ চারটির উপরে পাঁচটি রতন্ স্থাপিত হয়েছে। রত্ন সমূহের উপরিভাগ পিরামিড আদলের চৌচালা ছাদে আচ্ছাদিত। মন্দিরের চারদিকের বারান্দাসমূহ তিনটি করে অর্ধবৃত্তাকার খাঁজখিলান পথে উন্মুক্ত।
মন্দিরটি কে, কখন নির্মাণ করেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে মন্দিরটির পশ্চিম বহির্দেয়ালগাত্রের শীর্ষভাগে স্থাপিত একটি ভগ্ন শিলালিপিতে প্রেমনারায়ণস্য দৃষ্টে পুঠিয়া রাজবংশ গ্রন্থের লেখক বিমলাচরণ মৈত্রেয় অনুমান করেছেন যে, হয়তোবা মন্দিরটি রাজা প্রেমনারায়ণ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। তাঁর এই অনুমান যথার্থ হলে মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে নির্মিত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।

12 October 2018

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
























রাজশাহী জেলার “পুঠিয়া উপজেলা” ইতিহাস ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত। এখানে উল্লেখ করা যায় তদানীন্তন ভরত বর্ষের জমিদার বংশগুলির মধ্যে পুঠিয়ার জমিদার বংশ প্রাচীন ও অন্যতম জমিদার বংশ হিসাবে ইতিহাসখ্যাত। এই জমিদার বংশের উদ্ভব ঘটে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসন আমলে এবং ১৯৫১সালে তদানীন্তন পাকিস্তান শাসনামলে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে পুঠিয়া জমিদার বংশের অবসান ঘটে।
এই বংশের প্রথম পুরুষ বৎসাচার্য কুলীণ ব্রাহ্মণ বৎসাচার্য পুঠিয়ায় একটি আশ্রম পরিচালনা করতেন। ১৫৭৬ সালে মুঘল সম্রাট আকবরের সুবেদার মানসিংহের বাংলা দখল করার সময় আফগানদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সে সময় পুঠিয়া এলাকার আফগান জায়গীয়দার লস্কর খাঁনের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে লস্কর খাঁন পরাজিত হন। যুদ্ধে মানসিংহকে বৎসাচার্য বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন বিনিময়ে মানসিংহ তাঁকে পুঠিয়া এলাকার জমিদারী দান করেন। বৎসাচার্য ছিলেন সাধু পুরুষ। তিনি জমিদারীটা নিজ নামে না নিয়ে তাঁর পুত্র পীতম্বর এর নামে বন্দোবস্ত নেন। মানসিংহ মুঘল সম্রাট আকবর এর নিকট থেকে অনুমোদন সংগ্রহ করেন।
এইভাবে পুঠিয়া জমিদারীর উত্থান ঘটে। জায়গীরদার লস্কর খাঁনের নাম অনুসারে নামকরন হয় লস্করপুর। তাঁর নাম অনুসারে পুঠয়ায় একটি মহাবিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় “লস্করপুর মহাবিদ্যানিকেতন”। লস্কর খাঁনের জমিদারী হারানোর ঘটনার জনশ্রুতি রয়েছে। বহুল প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, “লস্কর খাঁন তা রাজকর্মচারীকে দায়িত্ব দিয়ে হজ্বব্রত পালনের জন্য মক্কা গমন করেন, হজ্বব্রত পালন শেষে ফিরে পুঠিয়ার অদূরে তারাপুর নামক স্থানে খবর পান তাঁর জায়গীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী তার নিজ নামে করে নিয়েছে লস্কর খাঁনের সফর সঙ্গীগণ পুঠিয়া প্রবেশ না করার পরামর্শ দেন। এরপর আর কোন দিন কোথাও লস্কর খাঁনের পাওয়া যায়নি।” এ ঘটনার কোন ঐতিহাসিক প্রমান নাই।
পীতম্বর এই জমিদারীর প্রথম পুরুষ তিনি জমিদারীর আয়তন বৃদ্ধি করেন। পুঠিয়া রাজবাড়ী তাঁর সময়ে নির্মিত হয়। রাজবাড়ীর তিন দিকে পরিখা এবং সম্মুখভাবে ৭ একর আয়তন পুস্করনী খনন করা হয়। উক্ত পুস্করনী “শ্যাম সাগর” নামে অভীহিত। পীতম্বর প্রজা দরদী অভিহিত। তিনি নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তাঁর পঞ্চম সহোদর নীলাম্বর উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারী প্রাপ্ত হন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিদান করেন। তখন থেকে এই বংশ ‘রাজবংশ’ নামে খ্যাত হয়।

নীলম্বরের মৃত্যুর পর জমিদারী লাভ করেন তাঁর পুত্র পুষপরাক্ষ। পুষপরাক্ষ নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুরণ করলে তাঁর বড় ভাই আনন্দরাম সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। আনন্দরামও মুঘল সম্রাট কর্তৃক ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। রাজা আনন্দরামের পর তাঁর একমাত্র পুত্র রতিকান্ত জমিদার হন। রতিকান্ত দিল্লীর সম্রাট কর্তৃক ‘ঠাকুর’ উপাধিতে আখ্যায়িত হন। রতিকান্তের তিন পুত্রের মধ্যে শেষের দুজন নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্র সকল সম্পত্তির মালিক হন। রামচন্দ্র ধর্ম-কর্ম, দান-ধ্যান ও জন হিতকর কার্য্যাবলীর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার চার পুত্র রূপনারাধয়ণ, নর নারায়ণ, দর্প নারায়ণ এবং জয়
নারায়ণ। চার পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র রূপনারায়ণ নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তৃতীয় ও চতুর্থ পুত্র দর্পনারায়ণ ও জয় নারায়ণ চৌপুখুরিয়া ও সিরোইল এ আলাদা জমিদারীর পত্তন ঘটান। ফলে পুঠিয়া রাজবংশের সকল সম্পত্তির একক মালিকানা লাভ করেন রামচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র নরনারায়ণ এরপর তাঁর একমাত্র পুত্র প্রেমনারায়ণ রাজ্যধিকার পান। প্রেমনারায়ণের পর স্বীয় একমাত্র পুত্র অনুপনারায়ণ সম্পত্তির মালিক হন।

সে সময় পুঠিয়া জমিদারী ১৫টি পরগণায় বিস্তৃত ছিল। জমিদারীটি বার্ষিক ১,২৫,৫১৬ টাকা খাজনায় বন্দোবস্ত হয় মুর্শিদকুলী খাঁনের সঙ্গে। অনুপনারায়ণের পর পুঠিয়া জমিদারী তাঁর চারপুত্রের (যথাক্রমে নরেন্দ্র, মেদ নারায়ণ, রূপ নারায়ণ ও প্রাণ নারায়ণ) মধ্যে বিভক্ত হয়। ভাইদের সংঘটিত মনোমালিন্য এ বিভক্তির কারণ বলে প্রতীয়মান হয়। সম্পত্তি বন্টিত হয় ১১৬১ বঙ্গাব্দে (১৭৪৪খৃঃ)। বিভক্তির সময় কনিষ্ঠ ভাইগণ তাদের নিজ নিজ চারিআনা অংশের মধ্যে থেকে অর্ধআনা অংশ জ্যেষ্ঠ ভাইকে প্রদান করেন। ফলে নরেন্দ্র নারায়ণের অংশে পাঁচআনা এবং কনিষ্ঠ তিন ভাই এর প্রত্যেকের অংশে সাড়ে তিনআনা নির্ধারিত হয়।
পরবর্তী উত্তরাধিকারীগণ বংশ পরম্পরায় “পাঁচআনীর রাজা” নামে অভিহিত হন। অপর কনিষ্ঠ তিন ভাই যাঁরা সাড়ে তিন আনার অংশীদার তাঁদের মধ্যে রূপেন্দ নারায়ণ নিঃসন্তান ছিলেন। রাজেন্দ্র নারায়ণ কে দত্তক প্রহণ করে উত্তরাধিকারীত্ব দেন। রাজেন্দ্র নারায়ণ নিজ অংশ সাড়ে তিন আনা এর সঙ্গে অপর শরীকের (রবীন্দ্র নারায়ণ) এক আনা তিন গজ অংশ দান হিসাবে লাভ করায় তাঁর সম্পত্তি মোট চারআনা তের গন্ডা হয়। ফলে তাঁর শাখা “চারআনা” নাম অভিহিত হয় পাঁচআনি রাজা নরেন্দ্র নারায়নের জ্যেষ্ঠ পুত্র ভুবনেন্দ্র নারায়ণ জমিদারী প্রাপ্ত হলে জমিদারীর আয় বৃদ্ধি করেন। কিছু সম্পত্তি দেবোত্তর হিসাবে নির্ধারণ করেন।
তিনি পুঠিয়ায় চারতলা বিশিষ্ট বিরাট ও সুদৃশ্য দোল মঞ্চ নির্মাণ করেন। এই ব্যয় বহুল ইমারতটি এখনও বর্তমান রয়েছে।১২১৩ বঙ্গাব্দে ভূবনেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যু হলে একমাত্র পুত্র জগন্নারায়ণ সকল সম্পত্তি মালিক হন। ১২১৬ সালে (১৮০৯খৃঃ) চিরোরোগা এক পুত্র রেখে মৃত্যুবরণ করেন। কিছুদিন পর রোগা পুত্রটি মারা গেলে জগন্নারায়নের স্ত্রীরাণী ভুবনময়ী দত্তক গ্রহণ করেন। এবং জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাণী ভূবণময়ী প্রজাদরদী ছিলেন। তিনি শীতকালে দরিদ্র প্রজদের বস্ত্র এবং বর্ষাকালে গোখাদ্য বিতরণ করতেন। পুঠিয়া রাজবাটিতে প্রবেশদার সংলগ্ন বাম দিকে অবস্থিত বিরাট সুদৃশ্য শিব মন্দির তাঁর পৃষ্ঠ পোষকতার নির্মিত হয়।
এই মন্দির নির্মাণে তিন লক্ষ মুদ্রা এবং সাত বছর সময় ব্যয় হয়। বিমলা চরণ মৈত্রেয় তার পুঠিয়া রাজবংশ উল্লেখ করেছেন। যে,প্রথম শুরু হয়।১২৩০ বঙ্গাব্দে শেষ হয় ১২৩৭ বঙ্গাব্দে। ভুবণেশ্বর শিবমন্দিরটি আজ দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকগণ পরিদর্শন করে থাকেন। রাণী ভুবণময়ী তার কন্যা কাশীশ্বরী দেবী ও দৌহিত্র গোবিন্দ্র প্রসাদ খাঁকে লস্করপুর পরাগণার কতিপয় মৌজা দান করেন।

এই ভাবে পুঠিয়া খাঁ বাবু জমিদার বংশের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা হয়। বাকী সম্পত্তি রাণী তার দত্তক পুত্র হরেন্দ্র নারায়ণ কে দান করেন। একমাত্র পুত্র যোগেন্দ্র নারায়ণ পিতা হরেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু পর জমিদারীর দায়িত্ব পান। যোগেন্দ্র নারায়ণ ১১ বছর বয়সে পিতৃহীন হলে তাঁর সম্পত্তি, Court of wards এর অধীনে ন্যাস্ত হয় (১৮ বছর বয়স পর্যন্ত Court of wards এর তত্ত্বাবধানে থাকার অইন ছিল।) যোগেন্দ্র নারায়ণের ১৫ বছর বয়সে পুঠিয়ার ভৈরবনাথ স্যানালের ( একজল ধনী জোতদার ) সাড়ে ৫ বছর বয়সীকণ্যা শরৎ সকুন্দরীর সঙ্গে বিয়ে হয়। বৃটিশ সরকারের আইন অনুযায়ী জমিদারী কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর অধীন যায়।
এই সময়ে যোগেন্দ্র নারায়ণের সুশিক্ষার জন্য প্রথমে রামপুর বোয়ালিয়ায় রাজশাহী জেলা স্কুলের নিম্ন শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়।পরে তাঁকে করিকাতাস ওয়ার্ডস ইন্টিটিউসনে প্রেরণ করা হয়। যোগেন্দ্র নারায়ণ নিজে শিক্ষা গ্রহণের মাঝে স্ত্রী শরৎ সুন্দরীকে ও শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা করেন। ফলে স্বামী স্ত্রী দুজনেই অল্প সময়ের মধ্যে লেখাপড়া শিখে ফেলেন। ১২৬৭ বঙ্গাব্দে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে পহেলা বৈশাখ জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।সম্পত্তি তার স্বহস্তে গ্রহণ করেই কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। পূর্ব থেকে নীলকরদের অত্যাচার জ্ঞাত ছিলেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেন। তাঁর আগে নীল কুঠিয়ালদের সৎ পথে আসার জন্য সদুপদেশ দেন ।তাতে কোন ফল না হলে প্রজা কৃষকদের স্বর্থ সংরক্ষণের জন্য লাঠিয়অল বাহিনী তৈরী করেন।

হাজার হাজার লাঠিয়াল যোগ দেয় নীলচাষ প্রতিরোধ ব্যবস্থায়। কতিপয় নীল কুঠি লুন্ঠন করে। এবং নীল বীজ পুঠিয়ার শ্যামসাগরে নিক্ষেপ করে। কয়েকটি স্থানের নীলকুঠির অত্যাচার সামান্য দিনের জন্য প্রশমতি হইল।যোগেন্দ্র নারায়ণ এর পরিকল্পনার আংশিক জয় হইল বটে কিন অত্যাধিক অনিয়ম ও পরিশ্রমের ফলে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। অল্পদিনের মধ্যেই আপোসের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তিনি মনে করতেন প্রাজাগণ তাঁর সহোদর ভ্রাতা। এই ভাবে রোগশোকে ভুগে ১২৬৯ বঙ্গাব্দে ২১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর সময় শরৎসুন্দুরীর বয়স ছিল ১৩ বছর। এই কিশোরী বয়সেই তিনি হিন্দু বিধাবার সকল নিয়ম নিষ্ঠা যথাযথ পালন করতে শুরু করেন। স্বামী যোগ্রেন্দ্র নারায়ণ মৃত্যুর পূর্বে সকল সম্পত্তি স্ত্রী শরৎসুন্দরীর নামে উইল করে যান জমিদার Court of wards এর তত্ত্বাবধানে থাকার পর দায়িত্ব প্রাপ্ত হলে শরৎসুন্দরী ১২৭২ বঙ্গাব্দে জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শরৎসুন্দরী ছিলেন ভিন্ন ধর্মী জমিদার। বাংলাদেশের ইতিহাসে সাহিত্য ও জন শ্রুতিতে বাংলার জমিদারবর্গ অত্যাচারী প্রজাপীড়ক শোষক হিসাবেই চিত্রিত। কিন্তু এদের মদেধ্য দু’চারজন ব্যতিক্রমধর্মী প্রজা দরদী জমিদারদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
শরৎসুন্দরী তাদের একজন। প্রজাবৃন্দের দুঃখমোচন ও সুখ বৃদ্ধির জন্য তিনি সদা সচেতন থাকতেন। হৃদয়ে ভোগেচ্ছার লেশমাত্রও ছিলনা বরং তিনি চাইতেন প্রজাদের মধ্যে যা আছে তা সবকিছু বিলিয়ে দিতে। শরৎ সুন্দরী সকল কর্মাকান্ডের প্রতি ওয়াকেফহাল হয়ে বৃটিশ কর্তৃপক্ষ ১২৮১ বঙ্গাব্দে রাণী উপাধি এবং দিল্লীর দরবার থেকে ১৮৭৭ খৃঃ মহারাণী উপাধিতে ভূষিত করা হয়। শরৎসুন্দরী রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় কলেজে ভবনে ও প্রাচীন নির্মানের জন্য দান করেন। শাশুড়ী শরৎসুন্দরী মৃত্যুবরণ করলে হেমন্ত কুমারী পুঠিয়া জমিদারীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। রাণী শরৎসুন্দরী নিঃসন্তান ছিলেন। তাই প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রজনীকান্ত কে দত্তক হিসাবে গ্রহণ করেন। এবং তার নাম রাখেন যতীন্দ্র নারায়ণ।
১২৮৭বঙ্গাব্দে ঢাকা জেলার ভুবনমোহান রাযের কণ্যা হেমন্তকুমারীর সঙ্গে যতীন্দ্র নারায়নের বিয়ে দেন। ১২৯১ বঙ্গাব্দে যতীন্দ্র নারায়ণ মৃত্যু হয়। এর দুবছর পর ১২৯৩ বঙ্গাব্দে মহারাণী শরৎ সুন্দরী মৃত্যুবরণ করেন। মহারাণী শরৎসুন্দরীর ন্যায় হেমন্ত কুমারী প্রজা দরদী দানশীল হিসাবে খ্যতি অর্জন করেছিলেন। হেমন্তকুমারী প্রজাকল্যানের জন্য সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। রাজশাহী শহরবাসীর পানীয়জলের জন্য ওয়াটার ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজও অমর হয়ে আছেন। সংস্কৃত শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য রাজশাহীতে সাংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন । তাছাড়া ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাস নির্মাণ

করেন। এই হিন্দু ছাত্রাবাসটি হেমন্তকুমারী ছাত্রাবাস নামে তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। তিনি মহারাণী উপাধীতে ভুষিত হন। হেমন্ত কুমারীর একমাত্র কন্যা সুরেন্দ্র বালা জমিদারীর উত্তরাধীকারী ছিলেন। কিন’ মহারাণী হেমন্ত কুমারী তার দৌহিত্রকে (কুমার অনিময় নারায়ন , কুমার শচীন্দ্র নারায়ন ও কুমার নিখিলেশ্বর)উত্তরাধীকারী দান করেন। ১৯৪৭সালে দেশ বিভাগের সময় তারাই ছিলেন পাঁচ আনি জমিদারীর বড় তরফের জমিদার।
পরেশ নারায়ন চারআনি রাজবংশের চতুর্থ পুরুষ। নাবালক কালে তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। ফলে পিতা ভুপেন্দ্র নারায়নের মৃত্যুর পর জমিদারীভার ন্যাস্ত হয়। Court of wardsএর উপর। এসময় নারায়ন কলিকাতায় ওয়ার্ডস ইনষ্টিটিউটে শিক্ষালাভের জন্য গমন করেন। এখানে একটি কথা বলা যেতে পারে যে, মহারাণী শরৎসুন্দরী স্বামী পাঁচআনি রাজবংশের নাবালক জমিদার যোগেন্দ্র নারায়ন ও একই প্রতিষ্ঠানে একই সময়ে লেখা পড়া করতেন। বয়োঃপ্রাপ্ত হয়ে পরেশ নারায়ন জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাজা পরেশ নারায়ন নিষ্ঠাবান সদ্যচারী প্রজাদরদীই ছিলেন না তিনি শিক্ষানুসারীও ছিলেন। তিনি শিক্ষার আলো জ্বালাতে প্রয়াস পান। তাই তিনি পুঠিয়া, রামপুর বোয়ালিয়া, কাপাসিয়া, জামিরা ,বানেশ্বর আড়ানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তিনি ১৮৬৪ খৃঃ পুঠিয়ায় মধ্যশ্রেণীর বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন। যে টি পরবর্তী কালে অর্থাৎ ১৮৭১খৃঃ উচ্চ ইংরেজী স্কুলে পরিনত হয়।তিনি ১৮৬৬ খৃঃ পুঠিয়ায় একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করে সাধারন মানুষের চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করেন। রাজা পরেশ নারায়ন নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে বিধবা পত্নী রাণী মনোমোহনী নরেশ নারায়ন কে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। নরেশ নারায়ন চারআনি রাজবংশের শেষ পুরুষ।

নরেশ নাটোরের রাজা জিতেন্দ্র নাথের দ্বিতীয় কন্যা সুরেশ্বরীকে বিয়ে করেছিলেন। সুরেশ্বরী দেবীর কোন পুত্র সন্তান ছিলনা। ৪ টি কন্যা সন্তান(পান্না, রেনু , রেবা ও গীত) ছিল। পান্নার বিয়ে হয় ভুপেন্দ্র নাথ (পাবনা) রেনুর জগদিন্দ্রনাথ মৈত্র (পাবনা) রেবার শীতাংশ কুমার আচার্য চৌধুরী (মোমেনশাহী) এবং গীতার বিয়ে হয় রবেন্দ্র মৈত্র (পাবনা) কথিত আছে যে , নরেশ নারায়নের পুত্র সন্তান না কায় রাণী সুরেশ্বরীর সংগে তাঁর সুসম্পর্ক ছিলনা। প্রায়শঃ রাজা নরেশনারায়ন কলিকাতায় অবস্থান নিতেন। অতঃপর সেখানে বেগম নামে এক মুসলিম রমনীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং মুসলমান হয়ে রমণীকে বিয়ে করেন। রাজা নরেশ নারায়ন র্র্তাঁর তৃতীয় কন্যা রেবা ও জামাতা শীতাংশুকুমার আচার্য চৌধুরী মালদহ জেলায় অবস্থান কালে প্রায়শঃ যাতায়াত করতেন। এই সুযোগে রাণী সুরেশ্বরী রেবার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নরেশ নারায়নকে বিষ পানে হত্যা করে। রাজার মৃর্ত্যুর খবর পেয়ে ২য় স্ত্রী রেগম কলিকাতা থেকে পুঠিয়া চলে আসেন এবং রাজা নরেশ নারায়নের জমিদারী দখল করেন। বেগমের পুঠিয়া আগমনে রাজশাহী নেতৃস্থানীয় মুসলমানবর্গ স্বাগত জানান। ঘটনা যাই হোক না কেন পুঠিয়া চারআনি রাজবাড়ীতে দীর্ঘদিন বেগম নামে এ মুসলিম মহিলা অবস্থানের পরে ১৯৮৭সালের ৩০শে ডিসেম্বর তিনি মারা যান। এই ঘটনা সম্প্রতিকালের অনেকের দেখা এবং জানা।

চারআনি এবং পাঁচআনি রাজবংশের রাজা বা জমিদারগণ পাশাপাশী বাস করলেও তাঁদের মধ্যে সমপ্রীতি ছিল না। প্রধানত জমিজমা নিয়েই মনোমালিন্য দেখা দিত। অনেক সময় আবাদী জমির দখল নিয়ে সংঘর্ষ বেধে যেত। পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চর দখলে উভয় রাজাগণই লাঠিয়াল ব্যবহার করেছেন এমন ঘটনা পাওয়া যায়। একে অপরের কর্মকান্ডের মধ্যে প্রভাব রাখতে সচেষ্ট থাকত। রাজশাহী নাটোর রোড সংলগ্ন শিবপুর নামক স্থানে প্রজাদের নিত্য প্রয়োজনীয় কেনাবেচার জন্য পাঁচআনি রাজা কর্তৃক হাট বসার ব্যবস্থা করা হয়। পাঁচআনি রাজা ও চারআনি রাজাদের অনুগত পৃথক প্রজা থাকায় চারআনি রাজার অনুগত প্রজাদের হাটে কেনাবেচা নিরাপদ ছিলনা। তাই চারআনি রাজার প্রজাগন পৃথক হাট বসানোর উদ্যোগ নেন। চারআনি রাজা পরেশ নারায়নের পুত্র রাজা নরেশনারায়ণ এই উদ্যোগকে গ্রহণ করে তার এলাকা বানেশ্বর হাট বসানোর অনুমতি দেন। শিবপুর হাট বসতো শনিবার ও মঙ্গলবার। অপরদিকে বানেশ্বর হাট বসতো শুক্রবার ও সোমবার। রাজাদের অধিকাংশ প্রজা ছিল মুসলমান। তাই প্রজাসাধারন জুম্মা নামাজের সুবিধার্থে হাটের দিন বদল করে শনিবার ও মঙ্গলবার ধার্য করে দেয়। একই দিবসে দুটি হাট বসতে থাকলে নিরাপত্তার কারণে অধিকাংশ প্রজা বানেশ্বরে আসতে থাকে এবং জমজমাট হাটে রূপ নেয় অপরদিকে শিবপুর হাটটি ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যায়।পুঠিয়া রাজবংশের প্রতিযোগীতামূলকভাবে ধর্মীয় উৎসব গুলো ধুমধাম করে পালন করা হতো। এর মধ্যে রথযাত্রা উল্লেখযোগ্য।
পুঠিয়াতে পাঁচআনি তরফ এবং চারআনি তরফে পৃথক রথ হত। তবে এরাই পুঠিয়াতে রথযাত্রার প্রবর্তক নয়। রাজবংশ নানা তরফে বিভক্ত হয়নি তখনও পুঠিয়াতে রথযাত্রা উৎসব হত। তার নিদর্শন এখনও দৃষ্ট হয়। পুরীর আদর্শে রথের সড়ক ছিল। পুস্কুরণীর ভিতর মন্দির ছিল, কান্দ্রা কৃষ্ণপুরের সীমানা দিয়ে যে পথ পশ্চিমাভিমুখে তারাপুর অঞ্চলে গিয়েছে তা এখন “রথগলি” বলে অভিহিত করে থাকে। তারাপুরে বৃহৎ পুস্কুরণীর মধ্যে মন্দির ছিল ঠাকুর সেখানে যেতেন যার ভগ্নাবশেষ এখনো বিদ্যামান রয়েছে।তা রথবাগিচা তারাপুর নামে খ্যাত। পুঠিয়া রাজবংশ বিভিন্ন শরিকে বিভক্ত হবার পর সককল শরিকেরই রথ ছিল। বিশেষ করে পাঁচআনি ও চারআনি উভয় তরফেরই বৃহৎকার সবুজ বর্ণ মিশ্রিত কাঠের মনো মোহিনীর(পরেশনারায়ণের স্ত্রী) আমলে পিতলের রথ প্রবর্তিত হয়।

পাঁচআনি তরফে মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী বিশ হাজার টাকা মূল্য চারআনি অপেক্ষা বড় আকারে পিতলের রথ তৈরী করেন। উভয় তরফেই রথের উৎসব বড় আয়োজন করত। রথ উৎসবে যাত্রা, পালা, ভাসান, যাত্রা, সার্কাস, খ্যামটা গান, আলকাপগান, কবিগান প্রভৃতিতে জাঁকজমকপর্ণ মেলা বসতো। কলিকাতা থেকে নামকরা যাত্রাপালা দল ও নর্তকী আনা হতো এবং ভালো মিষ্টি তৈরীর কারিগর ও আনা হতো। পাঁচআনি ও চারআনি রাজাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো কে বেশী খরচ করতে পারে। রথ উৎসব ছিল একমাত্র বড় উৎসব । হিন্দু মুসলমান উভয় সমপ্রদায়ের লোকজন সমাগাম হতো এই উৎসবে। এ দৃষ্টি কোন থেকে এই রথ উৎসব সার্বজনীন ছিল।
পুঠিয়া রাজবংশের সন্তানদের শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি খেলাধুলার ব্যবস্থা ছিল। পুঠিয়া স্কুল মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলত। রাজবংশের ছেলেরা ছাড়াও অন্য স্কুলের বালকরা ও ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেত। রাজকুমারীরা সুখ ও সোহাগে পালিত হতো। সংসারের তো নয়ই ব্যক্তিগত কাজও তারা জানতো না। আপন চুল বাঁধাতে জানতো না দুয়ারে খিল আটকাতে জানতো না। এমন কি রান্না করতে ও জানতো না।
পুঠিয়া রাজবংশের লোকেরা শিক্ষার জন্য বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে এবং জ্ঞান বিকাশিত করার জন্য রাজবাড়ীতে ১টি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। সেখানে দু সপ্রাপ্য মূল্যবান বইপত্র ভরপুর ছিল। জমিদারী প্রথা ১৯৫১ সালে বিলুপ্ত হইলে লাইব্রেরীটি পরিচালকের শূন্যতা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর বিখ্যাত এই লাইবেরীটির ষাটের দশকে বইপত্র আসবাব এমনকি ভবনের ছাদও ধ্বসে পড়ে এইভাবে একটি প্রাচীন লাইব্রেরী ধ্বংশ প্রাপ্ত হয়। প্রাণ নারায়নের বংশ ধরগণ সাড়ে তিনআনি রাজবংশ নামে পরিচিত। প্রাণ নারায়নের পরবতী বংশধরগণ বিভিন্ন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টিত হয়ে অসংখ্য মালিকানার সৃষ্টি করে। ১৯৫০ সালে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত আইন পাশ করে। এই জমিদারী প্রথা বিলোপ আইন পাশের মধ্যেদিয়ে ১৯৫১ সালে বাংলার প্রাচীন জমিদারী অসংখ্য মালিকানা ভুক্ত পুঠিয়া রাজবংশের অবসান ঘটে।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্র পত্রিকা
১। রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, কালিনথ চৌধুরী কলিকাতা ইসকুল, বুকপ্রেস, ১৯০১ সাল।
২। পুঠিয়া রাজবংশ, বিমলা চরণ মৈত্রেয়,১৩৫৭বঙ্গাব্দ, প্রকাশক বঙ্কিমচন্দ্র, মৈত্রেয়, কলিকাতা।
৩। রাজশাহীর ইতিহাস, কাজী মোহাম্মদ মিছের শিবগঞ্জ, বগুড়া , ১৯৬৫।
৪। সূবর্ণ দিনের বিবর্ণস্মৃতি, মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ প্রকাশক,লেখক, নভেম্বর ১৯৮৭ সালে।
৫। বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস, সম্পাদনা পরিষদ , এপ্রিল ১৯৯৮।
৬। বাংলাদেশের ইতিহাস(১৯৪৭-৭১),ডাঃ মোঃ মাহবুবুর রহমান, সময় প্রকাশন, অক্টোবর ১৯৯৯।
৭। রাজশাহী এসোসিয়েশন সাহিত্য পত্রিকা, এপ্রিল ১৯৯৪, সম্পাদক তসিকুল ইসলাম।
( সৌজন্যঃ কল্পন, পুঠিয়া সাহিত্য পরিষদ।)
ভিডিও দেখতে  ক্লিক করুন
ইমেল করুন

পাঁচ আনি রাজপ্রাসাদ

পাঁচ আনি রাজপ্রাসাদ




রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক হতে দক্ষিণে এক কি.মি. গিয়ে পুঠিয়া বাজার ও দোলমন্দির পেরিয়ে বিশাল মাঠ, মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে এবং শ্যাম সরোবরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় এটি অবস্থিত। ৪.৩১ একর ভূমির উপর নির্মিত এই প্রাসাদটি তিনটি অঙ্গনে বিভক্ত যথা- প্রশাসনিক অঙ্গন বা কাছারিবাড়ি, মন্দিরাঙ্গন, এবং অন্দরাঙ্গন বা অন্দরমহল। প্রাসাদটির সম্মুখে বিশাল দুটি গাড়ি বারান্দা এবং দ্বিতলে দরবার হল বিদ্যমান।
গাড়ি বারান্দা দুটিতে চারটি করে আটটি এবং প্রাসাদের টানা বারান্দার সম্মুখে চারটি, মোট বারটি সুবিশাল করিন্থিয় স্তম্ভ দ্বিতল পর্যন্ত উঠে গেছে। প্রাসাদের সম্মুখ দেয়ালে স্থাপিত (কাঠের সিঁড়ি সংলগ্ন) এক প্রস্তরলিপি অনুসারে প্রাসাদটি ১৮৯৫ সনে রানি হেমন্তকুমারী কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে জানা যায়। তিনি প্রাসাদটি নির্মাণ করে তাঁর স্বর্গীয়া শ্বাশুড়ী মহারানি শরৎসুন্দরীর নামে উৎসর্গ করেন।
আড়ম্বরপূর্ণ এই প্রাসাদটি এখনো দাঁড়িয়ে থেকে পুঠিয়ার রাজাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির বার্তা বহন করে চলেছে। ১৯৭২ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত লস্করপুর ডিগ্রী কলেজ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বর্তমানে দোতলায় যাদুঘর বানানো হয়েছে।

পঞ্চরত্ন শিবমন্দির

রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক হতে দক্ষিণে গিয়ে পুঠিয়া রাজবাড়ি এলাকায় প্রবেশপথের পূর্ব পাশের শিব সরোবরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত সুউচ্চ এই মন্দিরটি পুঠিয়ার মন্দির স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। সুউচ্চ (১১ইঞ্চি-৮ইঞ্চি) ও সুবিশাল এক বর্গাকার (65ইঞ্চি-0ইঞ্চি×65ইঞ্চি-0ইঞ্চি) মঞ্চের উপর এক কক্ষ বিশিষ্ট এই মন্দিরটির প্রতিটি রত্নের উপরিভাগ ক্রমান্বয়ে সজ্জিতাকারে স্থাপিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতকগুলো সুঁচালো চূড়ায় আচ্ছাদিত। কেন্দ্রীয় কক্ষের অভ্যন্তরে কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত একটি বিশালাকৃতির শিবলিঙ্গ স্থাপিত রয়েছে। কেন্দ্রীয় কক্ষ ও তার চারিদিকের প্রদক্ষিণ বারান্দার চার কোণের অভ্যন্তরস্থ উপরিভাগ
অর্ধবৃত্তাকৃতির গম্বুজে ও চার বলয় চৌচালা ছাদে আচ্ছাদিত। প্রদক্ষিণ বারান্দার চারিধার মোগল রীতির খাঁজখিলান পথে উন্মুক্ত। মন্দিরটির সুউচ্চ মঞ্চে আরোহণের জন্য উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটি সিঁড়িপথ বিদ্যমান। ১৮২৩-১৮৩০ সনে রাজা জগন্নারায়ণের স্ত্রী রানি ভুবনময়ী এটি নির্মাণ করেন। এটি নির্মাণে সে সময় তিন লক্ষ মুদ্রা ব্যয় হয়েছিল বলে জানা যায়। পূর্বে মন্দিরায়তনের দ্বারের নিকট একটি জলঘড়ি ছিল যা বর্তমানে নেই।
জনৈক আচার্য ব্রাহ্মণ তা পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়। মন্দিরটির নির্মাণ কৌশল ও অলঙ্করণ অপূর্ব। এই মন্দিরের সৌন্দর্য উপভোগের লোভ স্বয়ং লর্ড কারমাইকেলও সংবরণ করতে না পেরে একদা তিনি এ মন্দির দর্শনের জন্য সকলের অগচোরে পুঠিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন বলে জানা যায় (সূত্র: বিমলাচরণ মৈত্রেয়, পুঠিয়া রাজবংশ, কলকাতা: প্যারিস আর্ট প্রেস, ১৯৫৩)।

অষ্টকোণা রথ মন্দির



পঞ্চরত্ন শিবমন্দির সংলগ্ন সামান্য পূর্ব দিকে এই মন্দিরটি অবস্থিত। কথিত আছে যে, প্রতি বছর রথপর্ব উদ্যাপনের সময় পঞ্চরত্ন বড় গোবিন্দ মন্দির হতে শ্রীরাধা, শ্রীগোবিন্দ, শ্রীগোপাল, শ্রীনিতাই ও শ্রীগৌরকে রথে চড়ে আট দিনের জন্য এখানে এনে রাখা হতো।

মহা ধুমধামের সাথে মন্দিরের পূর্ব পার্শ্বেই চলতো যাত্রা উৎসব। রথপর্ব শেষে পুনরায় এই বিগ্রহগুলোকে রথে চড়ে বড় গোবিন্দ মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো। রথপর্ব উদ্যাপন হতো বলেই সম্ভবত মন্দিরটি রথ মন্দির নামে পরিচিত। অষ্টকোণা এক কক্ষ ও একরত্ন বিশিষ্ট এই মন্দিরটি চারিধারে আটটি উন্মুক্ত খিলানপথ সংবলিত স্বল্প আয়তনের একটি বারান্দা বেষ্টিত। বারান্দার উপরিভাগ ছই আকৃতির খিলানছাদে আচ্ছাদিত হলেও রত্নের উপরিভাগ শীর্ষদণ্ড সংবলিত শিরাল গম্বুজে আচ্ছাদিত।

দোলমন্দির বা দোলমঞ্চ


পাঁচআনি রাজবাড়ির সম্মুখ মাঠের উত্তর প্রান্তে রাস্তা সংলগ্ন (পুঠিয়া বাজারে) এই মন্দিরটি অবস্থিত। মন্দিরটি ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে চারটি স্তরে নির্মিত। প্রতিটি স্তরই খিলান সারি দ্বারা উন্মুক্ত।

সর্ব্বোচ্চ স্তরের ক্ষুদ্র কক্ষটি শীর্ষদণ্ড সংবলিত শিরাল গম্বুজে আচ্ছাদিত এবং এই কক্ষে রাধা-কৃষ্ণের দোল খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায়। মন্দির গাত্রের এক শিলালিপি অনুসারে এটি রাজা ভুবনেন্দ্রনারায়ণ কর্তৃক ১৭৭৮ সনে নির্মিত হয়। বর্তমানে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে।

পঞ্চরত্ন বড় গোবিন্দ মন্দির


 

পাঁচ আনি রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে পূর্ব অংগনের (মন্দিরাঙ্গন) মধ্যস্থলে এই মন্দিরটি অবস্থিত। একটি সুউচ্চ বর্গাকার মঞ্চের উপর স্থাপিত মন্দিরটির ভূমি নকশা পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের মতই। তবে মন্দিরটির বহির্দেয়ালগাত্রের সম্পূর্ণ অংশ দিনাজপুরের কান্তনগরের নবরত্ন মন্দিরের ন্যায় পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অপূর্ব অলঙ্করণে সজ্জিত।

অলঙ্করণ বিষয়বস্তু হিসেবে রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলী উপস্থাপনের পাশাপাশি মুসলিম স্থাপত্য অলঙ্করণের বীমূর্ত বিষয়বস্তুসহ তদানীন্তন সমাজ ব্যবস্থারও একটা প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। ভূমি নকশা অনুযায়ী মন্দিরটি মূল গর্ভগৃহকে কেন্দ্র করে মূলত পাঁচটি বর্গাকার ও চারটি স্বল্প আয়তনের আয়তাকার কক্ষে বিভক্ত। চারদিকের আয়তাকার কক্ষ চারটি প্রকৃতপক্ষে বারান্দা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

বর্গাকার কক্ষ সমূহের অন্তরস্থ উপরিভাগ অর্ধবৃত্তাকৃতির গম্বুজ ও আয়তাকার কক্ষ বা বারান্দা সমূহের উপরিভাগ খিলানছাদে (ছই আকৃতির) আচ্ছাদিত হলেও বহির্ভাগ সমতল করে কেন্দ্রীয় কক্ষ এবং চার কোণার ক্ষুদ্র কক্ষ চারটির উপরে পাঁচটি রতন্ স্থাপিত হয়েছে। রত্ন সমূহের উপরিভাগ পিরামিড আদলের চৌচালা ছাদে আচ্ছাদিত। মন্দিরের চারদিকের বারান্দাসমূহ তিনটি করে অর্ধবৃত্তাকার খাঁজখিলান পথে উন্মুক্ত।

মন্দিরটি কে, কখন নির্মাণ করেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে মন্দিরটির পশ্চিম বহির্দেয়ালগাত্রের শীর্ষভাগে স্থাপিত একটি ভগ্ন শিলালিপিতে প্রেমনারায়ণস্য দৃষ্টে পুঠিয়া রাজবংশ গ্রন্থের লেখক বিমলাচরণ মৈত্রেয় অনুমান করেছেন যে, হয়তোবা মন্দিরটি রাজা প্রেমনারায়ণ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। তাঁর এই অনুমান যথার্থ হলে মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে নির্মিত বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।