টেরাকোটা



বর্তমান পুঠিয়ায় মোট ৫টি মন্দির টেরাকোটা শোভিত।যে সব মন্দিরে টেরাকোটা আছে সেগুলো হচ্ছে- 
১। বড় গোবিন্দ মন্দির- (লষ্করপুর ডিগ্রী কলেজের ভেতরে অবস্থিত)
২। ছোট গোবিন্দ মন্দির- (বেগমবাড়ীর সাথে এক রত্ন মন্দির)
৩। বড় আহ্নিক মন্দির- (ছোট গোবিন্দ মন্দিরের সাথে অবস্থিত)
৪। ছোট আহ্নিক মন্দির- (বড় গোবিন্দ মন্দিরের পেছনে অবস্থিত)
৫। ছোট শিবমন্দির- (লষ্করপুর ডিগ্রী কলেজের পেছনে অবস্থিত)
বর্তমানে মন্দিরগুলির অবস্থা সংকটাপন্ন। মন্দিরের টেরাকোটা চুরি হয় প্রতিনিয়ত। প্রয়োজনের তুলনায় রক্ষণা বেক্ষণের লোকবল কম।
পোড়ামাটির শিল্প মাত্রই টেরাকোটা। অধুনা টেরাকোটার অবস্থানগত দিক থেকে একে বিভিন্নভাবে দেখা হয়। যেমন- প্রাচীর চিত্র, অলংকার ইত্যাদি। মন্দিরের টেরাকোটাগুলি অনেক খন্ড খন্ড পোড়ামাটির ফলক দিয়ে তৈরি বলেই এগুলোকে সামগ্রিকভাবে টেরাকোটা বলা হয়েছে। এবং সেভাবেই এর উপস্থাপন করা হয়েছে। সামগ্রিক শিল্পকর্মটিকে আমরা টেরাকোটা টাইপ এবং এর ভিতরে পৌরাণিক, লতাপাতা, আলপনার যে সুক্ষ্ম চিত্রগুলি আছে সেগুলিকে মোটিফ বলছি।
পুঠিয়া রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা বৎসরাচার্য ছিলেন তান্ত্রিক সাধক। তাঁর বংশের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ শৈব বা শাক্ত হবে অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মে শক্তি উপাসনার একটা প্রবাহ থাকবে এটা স্বাভাবিক| পুঠিয়ায় ৯টি মন্দিরের মধ্যে ২টি শিব মন্দির। একটি বড় শিব মন্দির অপরটিকে ছোট শিব মন্দির। বড় শিব মন্দিরের সাথেই কালী মন্দির ছিল, যেটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বর্তমানে সেখানে একটি ‘কালীর থান’ আছে। তবে যতটা প্রকট হবার কথা ছিল এই শক্তি উপাসনা ততটা প্রকট হয়নি। কারণ, কালী বা শিব মন্দিরের তুলনায় এখানে গোপাল, দোল, গোবিন্দ, আহ্নিক মন্দিরের সংখ্যা বেশী। তবে আহ্নিক মন্দির গুলোতে কোন দেবতার ‘আহ্নিক’ (ধ্যান) করা হয় তা বলা যায় না। কারণ, সেগুলোতে কোন বিগ্রহ নেই। শক্তি উপসনার পাশাপাশি এর রাজবংশে চৈতন্য দেব প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের চর্চাও হত। তাই দেখা যায় যে শক্তি এবং মানবিকতার চর্চা এ রাজবংশে সমান্তরাল ভাবে চলছে। এই মিশ্রভাবাদর্শের প্রভাব দেখা যায় বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটায়।
টেরাকোটার বৈশিষ্ট্য 
ছোট আহ্নিক মন্দির, বড় গোবিন্দ মন্দির এবং ছোট শিবমন্দির- এই তিনটি মন্দিরের প্রত্যেকটিই এক রত্ন মন্দির। এই তিনটি মন্দিরের চার দিকই টেরাকোটা খচিত। ছোট গোবিন্দ মন্দির এবং বড় আহ্নিক মন্দিরের তিন দিক (সামনে, ডানে ও বায়ে- পেছনে নেই) টেরাকোটা খচিত। ছোট গোবিন্দ মন্দিরটি এক রত্ন হলেও বড় আহ্নিক মন্দিরটি স্থাপত্য রীতিতে দোচালা বাংলা ঘরের অনুরূপ। (যে মন্দিরগুলোর চূড়া একটি সেগুলোই এক রত্ন মন্দির। যে মন্দিরগুলোর উপরে চারকোণে চারটি এবং মাঝে একটি চূড়া আছে সেগুলো পঞ্চরত্ন মন্দির। অনুরূপ নবরত্ন মন্দির পর্যন্ত আছে। দিনাজপুরের কান্তজী মন্দির নবরত্ন মন্দির। পুঠিয়ার বড় শিবমন্দির পঞ্চরত্ন মন্দির)।
মন্দিরগুলোর দেয়ালগুলো অসংখ্য ছোট ছোট টেরাকোটা খন্ড দ্বারা শোভিত। খণ্ড খণ্ড টেরাকোটা মিলে এক একটি দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক মোটিফ। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটি দেয়াল এক একটি বিশাল ক্যানভাস। প্রতিটি খন্ডেই রয়েছে এক একটি পৌরাণিক কাহিনীর ইমেজ। পরস্পর সম্পর্কিত ইমেজগুলো পরপর সাজিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে একএকটি কাহিনী। প্রতিটি খন্ড সাধারণভাবে দৈর্ঘে ৫ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ৩ ইঞ্চি। তবে কখনো কখনো কোন কোন জায়গায় (বিশেষত কোণের দিকে) এই হিসাবের গর মিল হয়েছে। আর এটা হয়েছে মন্দিরগুলোর কাঠামোর গঠনের জন্য। আবার কখনো কখনো একটি ইমেজকে পূর্ণতা দিতেও খন্ডগুলো ছোট এবং ত্রিভুজাকৃতির করা হয়েছে।
বড় গোবিন্দ মন্দির, ছোট গোবিন্দ মন্দির এবং বড় আহ্নিক মন্দির এই তিনটি মন্দির উঁচু স্তম্ভের উপর নির্মিত। স্তম্ভগুলো প্রায় চার ফুট উঁচু। প্রতিটি মন্দিরের কার্নিশ থেকে শুরু করে স্তম্ভ বা মাটি পর্যন্ত টেরাকোটা খচিত।
কখনো কখনো এক খণ্ডে একটি ইমেজ শেষ হয় না। পরবর্তী খণ্ডে র্ধাংশ শেষ হয়। সে ক্ষেত্রে একটি ফুলের একটা পাপড়ীও যদি অপর খন্ডে যায় তাহলে তাই করা হয়েছে। কখনো কখনো ১০-১৩ টি খন্ড জোড়া লাগিয়ে একটি ইমেজ তৈরী করা হয়েছে। যেমন- ছোট শিবমন্দিরের চারকোণে (উপরে) সাপ খেকো ময়ূরের ইমেজ তৈরি করা হয়েছে ৩টি খন্ড জোড়া লাগিয়ে। আবার ছোট আহ্নিক মন্দিরের চারকোণে যে হনুমানের ইমেজ পাওয়া যায় তাও অনুরূপ সংখ্যক খন্ড জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা। এই ঘটনা বেশী ঘটেছে লতাপাতা বা আলপনার ইমেজ তৈরির সময়। ফুল-লতাপাতা-আলপনাগুলোর বেশীর ভাগই একাধিক খন্ড জোড়া লাগিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইমেজ তৈরি করা হয়েছে। এতে দুই খণ্ডের মাঝের ফাঁকটুকু বাদে মনে হয় একটি পূর্ণাঙ্গ খণ্ড।
মোটিফে পুরাণের প্রভাব: 
পুঠিয়ার মন্দিরগুলোর টেরাকোটার মোটিফ খুঁজলে পৌরাণিক কাহিনীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যে পাঁচটি মন্দিরে বর্তমানে টেরাকোটা আছে সেগুলোর মধ্যে মোটিফগত কোন মৌলিক পার্থক্য চোখে পড়ে না। প্রত্যেকটি মন্দিরেই তিন যুগের (সত্য, ত্রেতা, দাপর) পৌরাণিক কিংবদন্তী, বিভিন্ন যুদ্ধ সম্পৃক্ত কল্পিত প্রাণী (বিশেত ড্রাগন আকৃতির ঘোড়া), বিভিন্ন দেব-দেবীর ইমেজ পাওয়া যায়। দূর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, ব্রহ্মা প্রভৃতি দেব-দেবী তাদের কল্পিত প্রথাগত সাজসজ্জা এবং ভঙ্গি নিয়েই বর্তমান। মজার বিষয় হচ্ছে- পুঠিয়ার রাজপরিবারের স্থাপতি শৈব হলেও টেরাকোটার ইমেজগুলোতে শিবের চিত্র পাওয়া যায় না। শক্তির অপর দেবী কালীরও কোন ইমেজ পাওয়া যায়না। অথচ এই দুই পৌরাণিক শক্তির দেব-দেবীর গুরুত্ব ছিল তাদের কাছে অপরিসীম।
এই মোটিফগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
ক. কৃষ্ণ লীলা, খ. রামায়ন কেন্দ্রিক, গ. মহাভারত কেন্দ্রিক এবং ঘ. পৌরাণিক দেব-দেবী কেন্দ্রিক। অবশ্য এই চার ভাগের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে কাহিনী কেন্দ্রিক পশু-পাখি, ফুলও লতাপাতা এবং আলপনা।

No comments: